রাজধানীর বনানী এলাকার গোডাউন বস্তিতে অসচেতনতার কারণে বারবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হয়েছে।প্রায় তিন বছর আগে করোনার সময় আগুন লাগার পর রোববার (২৪ মার্চ) বিকেলে আবারো ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে ২২০টিরও বেশি ঘরবাড়ি। আগুনে পুড়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন হয়েছে প্রায় হাজারো মানুষ। এর মধ্যে অধিকাংশই শিশু।স্থানীয়রা জানান, বস্তির একটি ঘরে রান্নার সময় অসাবধানতা থেকে আগুনের সূচনা হয়। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ঘরবাড়িতেও ধরে যায়। এ বস্তিতে এর আগেও আগুন লেগেছিল। চার বছর আগে করোনার সময় এখানে বড় আগুনের ঘটনা ঘটেছিল। জীর্ণ ঘরবাড়ি এবং গ্যাসের চুলা ব্যবহারের অসতর্কতার ফলে বারবার এ বস্তিতে আগুন লাগছে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাব এবং বস্তির সরু রাস্তা আগুন নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বারবার আগুন লাগলেও স্থায়ী সমাধানের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না বলে বস্তিবাসীরা অভিযোগ করেন।সোমবার (২৫ মার্চ) রাজধানীর বনানী এলাকায় অবস্থিত গোডাউন বস্তিতে আগুন লাগার পর সরেজমিনে বস্তি ঘুরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা যায়।শাশুড়ি, স্বামী, ছেলে এবং নাতনিসহ ৬ সদস্যের পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে পুড়ে যাওয়া ঘর দেখছিলেন শাহিদা বেগম (৪৫)। পাশেই তার ছেলে এবং নাতনি পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে খুঁজে খুঁজে কি যেন একটা বের করার চেষ্টা করছিলেন। হয়ত পরিবারের শেষ কোনো সম্বল অবশিষ্ট আছে কিনা তাই খুঁজছিলেন তারা। আগুনে শাহিদা বেগমের নিজ ঘরসহ ভাড়া দেওয়া ঘরটিও পুড়েছে।চার বছর আগেও করোনার সময় এ একই ঘর তখনও আগুন লাগার কারণে পুড়েছে শাহিদা বেগমের। সেবার ঘরটি ঠিক করতে এবং আসবাবপত্র গড়তে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লেগেছিল। যার বেশির ভাগই ঋণ করেছিলেন। ২০ বছর ধরে গোডাউন বস্তিতে থাকাকালীন এ নারী দুইবার নিজ চোখে আগুন লাগা দেখেছেন, দুইবারই তিনি আগুনের ভুক্তভোগী ছিলেন।আগুনে সহায় সম্বল সব পুড়ে যাওয়ার পর সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবেন জানতে চাইলে ছ্বল ছ্বল চোখে শাহিদা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাসায় টাকা পয়সা তেমন একটা ছিল না। যা ছিল সবই আসবাবপত্র। চার বছর আগে যখন এ বস্তি পুড়েছিল তখন নতুন করে ঘর তোলার পর কিছু আসবাবপত্র করেছিলাম। সেগুলো সব পুড়ে গেছে। এখন পরনের কাপড় বাদে আর কিছু নেই। আমি এখনো গোসল করতে পারিনি, কারণ গোসলের পর যে কাপড় বদলাবো সে অবস্থা নেই। আজকে রোজাও রাখতে পারিনি।কেন বারবার আগুন লাগছে এ বস্তিতে এমন প্রশ্নের জবাবে শাহিদা বেগম বলেন, মূলত অসচেতনতার কারণেই গতকাল আগুন লেগেছিল। আমার ঘরের কয়েক ঘর পরে এক নারী তার ঘরে ইফতারির জন্য বুট সিদ্ধ দিয়েছিল। সেই বুটের পানি শুকাতে শুকাতে পুড়ে পাতিলে আগুন লেগে যায়৷ এর পরই সেখানে বিস্ফোরণ হয়ে পুরো বস্তি আগুনে পুড়ে যায়।বস্তিবাসীর সচেতনতার অভাবে আগুন লেগেছে বলে দাবি করেছেন বস্তির সামনের এক টং দোকানদার মো. বশির। নিজের ঘর আগুনে রক্ষাপেলেও ভাই নূরে আলম ভাই এবং বোনের মাইনুর বেগমের দুইটি ঘর পুড়েছে। আগেরবার যখন ঘর পুড়েছিল তখন ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নতুন ঘর করেছিলেন। এখন যতটুকু সমর্থ আছে সে অনুযায়ী নতুন করে আবারো ঘর তৈরি করবেন।দোকানদার বশির বাংলানিউজকে বলেন, বস্তিবাসীর সচেতনতার অভাবে আগুন লেগেছে। এখানের বেশির ভাগ গ্যাস লাইন অবৈধ, অনেক সময় গ্যাসের চাপ অনেক বেশি থাকে এবং সে লাইনের জয়েন্ট দুর্বল থাকে। পাশাপাশি এসব চুলায় যেসব নারী রান্না করেন তারা অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসা। কীভাবে এসব গ্যাসের চুলা সতর্ক হয়ে চালাতে হয়, তারা ভালো করে জানেন না। গ্যাসের প্রেসার যখন বেশি থাকে তখন কতটুকু গ্যাস ছেড়ে চুলা জ্বালাতে হবে, তারা সেটা ভালোভাবে জানেন না। যে কারণে এসব দুর্ঘটানা ঘটে।দোকানদার বশির বলেন, এ বস্তির পথগুলো এত সরু যে দুইজন পাশাপাশি থেকে হাঁটতে পারবে না। প্রতিটা ঘরের শোবার রুমে রান্না ঘর। আগুন লাগলে ধরাধরি করে সব বের করবে সে উপায় নেই। গতকাল আগুন লাগার পর আমার দোকানের মালামাল যখন সরিয়া রাস্তায় রেখেছিলাম। তখন এ বিপদের মাঝেও অনেকে যে যার মতো করে মালামাল নিয়ে চলে যাচ্ছিল। এ সময় আগুন নেভাবো না তাদের কিছু বলব।পুড়ে যাওয়া বস্তিতে শিশুদের জরুরি কি প্রয়োজন সেসব বিষয়ে তদারকি করছিল সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো।পুড়ে যাওয়া বস্তিতে কি পরিমাণ মানুষ ছিল এবং এর মধ্যে শিশুদের অবস্থা কেমন আছে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের স্যোশাল ওয়েলফেয়ার কনসালটেন্ট সায়মা ফেরদৌসী বাংলানিউজকে বলেন, পুড়ে যাওয়ার পর এ অংশের মানুষের এখন কিছুই নেই। সবার কাপড় পুড়ে গেছে৷ বাচ্চাদের খাবার, পানি কিছুই নেই। অনেক বাচ্চা এ পোড়া জায়গায় খালি পায়ে হাঁটছে।সমাজসেবা অধিদপ্তরের স্যোশাল ওয়েলফেয়ারের এ কনসালটেন্ট বলেন, স্বল্প মেয়াদের সহযোগিতার জন্য প্রথমে এখানের ২২০টি পরিবারের সব সদস্যদের বর্তমানে কি কি জরুরি প্রয়োজন সেসব তালিকা করছি, অনেকের নম্বরও রাখছি পরবর্তীতে যোগাযোগের জন্য। এসব পরিবারের প্রতিটিতে কম করে হলেও ৪ থেকে ৫টি শিশু আছে। শিশুসহ সবার জন্য করা সে তালিকা অনুযায়ী আমরা তাদের সাপোর্ট পাঠাবো। আর দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার জন্য আমাদের সামাজিক সুরক্ষার যে সংস্থাগুলো আছে তাদের সঙ্গে এদের কীভাবে লিঙ্ক করে দেওয়া যায় সে ব্যবস্থা করব। এসব সংস্থার অনেকে ভাতা দেয়। ফলে এ বস্তিবাসীরা কিছুটা সহযোগিতা পাবেন।
Post a Comment