বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বিবির পুকুর

বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বিবির পুকুরের ইতিহাস এখনও অনেকের অজানা।
বরিশাল শহরের অন্যতম সৌন্দর্যের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই পুকুরটি। আর এই পুকুরকে ঘিরে রয়েছে অনেক রুটি রুজির ব্যবস্থা। কেননা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে ভিড় জমায়। একসাথে আড্ডার পাশাপাশি চা চক্রে মেতে থাকে তারা। সন্ধ্যার পরপরই মনে হয় যেন সুখের স্বর্গ ।
খ্রিষ্ট ধর্মের প্রখ্যাত প্রচারক ডা. উইলিয়াম কেরির নাতি উইলিয়াম কেরি জুনিয়র বরিশালে এসে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন।তখন স্থানীয় ভূস্বামিনী জিন্নাত বিবির শুশ্রুষায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।পরে জিন্নাত বিবিকে বিবি জেনেট নাম দিয়ে পালিতা কন্যার মর্যাদা দেন উইলিয়াম কেরি জুনিয়র।ওই সময় স্থানীয়দের পানীয় জলের কষ্ট নিরসনের জন্য জিন্নাত বিবি একটি পুকুর খননে উইলিয়াম কেরি জুনিয়রের সহায়তা চান।সে অনুসারে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলা সদর বরিশাল শহরের প্রধান সড়ক সদর (জেল) রোডের পূর্বপাশে ৪০০ ফুট প্রস্থ ও ১৮৫০ ফুট দীর্ঘ একটি পুকুর খনন শুরু হয়।
কাজটি ১৯০৮ সালে শেষ হয়।জিন্নাত বিবির কোন সন্তান ছিল না।পুকুরের পশ্চিম পাড়ে তিনি বাস করতেন।ওই এলাকার নাম ছিল বিবির মহল্লা।পুকুরটিও কালক্রমে বিবির পুকুর হিসেবে খ্যাতি ও পরিচিত লাভ করে।বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্রে শতবছরের চিহ্ন ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে এই বিবির পুকুর।বরিশালের ঐতিহ্যের এ স্মারককে রক্ষা ও এর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে।সেই কাজ দীর্ঘ পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি।বরং যেটুকু কাজ হয়েছিল তাও অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে।বর্তমানে এটি নগরীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র।বিকালে ও সন্ধ্যায় নগরবাসী অবসর সময় কাটানোর জন্য পুকুর পাড় ও সংলগ্ন হিরন স্কয়ারে জড়ো হন।প্রতিদিনই অনেক রাত পর্যন্ত পুকুর পাড় থাকে লোকজনের সরগম।বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের (বিসিসি) প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরন ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর বিবির পুকুর রক্ষা ও এর সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নেন।২৭ মে ২০১২ সালে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ও গ্রামীণফোনের অর্থায়নে বিবির পুকুর সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।প্রকল্পের আওতায় রয়েছে পুকুরের চারপাশে ঝুলন্ত পার্ক, বসার বেঞ্চ, অত্যাধুনিক গ্রিল ও পুকুরের শোভা বৃদ্ধির জন্য লাইটিং ও ফোয়ারা স্থাপন। পাশাপাশি বিবির পুকুরের পাশেই করা হয় উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র।মেয়র হিরনের মৃত্যুর পর তা ‘হিরন স্কয়ার’ নামে পরিচিতি পায়।প্রকল্পের সমন্বয়কারী মাহবুবুর রহমান জানান, এক কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিবির পুকুরের সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।বিবির পুকুরের ইতিহাস এক নজরে জানতে এর উত্তর পাশে থাকবে একটি বোর্ড।থাকবে মিউজিক্যাল রঙিন ফোয়ারা।পুকুরের চারপাশে রোপন করা হবে বিভিন্ন প্রকারের গাছ।থাকবে উন্নত ওয়াকওয়ে।তিনি বলেছিলেন, নগরীর প্রাণকন্দ্রেরে চরিত্র পাল্টে দেওয়াটাই ছিল এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। প্রতিশ্রুত অনেক কিছুই এখনও করা হয়নি।কিছু কাজ করা হলেও তা ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে।প্রকল্প এলাকার রক্ষণাবেক্ষণেও নেই কোন উদ্যোগ।প্রকল্পের লাইটিং ও ফোয়ারার কাজ পেয়েছিলেন বিসিসি’র সাবেক একজন কাউন্সিলর।ফোয়ারা নির্মাণের পরপরই তাতে ত্রুুটি দেখা দেয়।বর্তমানে ফোয়ারা দুটি বিকল হয়ে পড়ে আছে।ধ্বসে পড়েছে ওয়াকওয়ের রেলিং।রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী ব্যানার-বিলবোর্ডে ঢেকে যাচ্ছে পুকুরের চারপাশসহ পুকুরের অপরুপ সৌন্দর্য্য।পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে গড়ে উঠেছে অজস্র রেন্ট-এ-কারের গাড়ি পার্কিং। পুকরের পাড় জুড়ে সৃষ্টি হয় গাড়ির কালো ধোঁয়া, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।বিনোদন পিয়াসীদের জন্য উপদ্রব হয়ে দেখা গিয়েছে পশ্চিম পাড়ে খোলা ডাস্টবিনের বিকট দুর্গন্ধ।উত্তর ও পশ্চিম পাড়ের অরক্ষিত ওয়াকওয়ে এবং বসার ব্যবস্থ না-থাকায় তা অনেক সময় হকারদের দখলে চলে যায়।পুকুরের মধ্যকার রঙিন আলোর ফোয়ারাও অচল বহুদিন ধরেই।জায়গাটি বেশ খোলামেলা ও শহরের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় পরিবেশ ও যাতায়াত সুবিধাও ভালো।অনেক রাত পর্যন্ত চলে জনসাধারণের আড্ডা, ভ্যানে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবারও পাওয়া যায়।এরমধ্যে চটপটি ও ফুচকার জুড়ি নেই। তবে বিলবোর্ডে পুকুরের পাড়গুলো অনেক সময় ঢাকা পড়ে যায়। খোলা ডাস্টবিনের দুর্গন্ধও বিব্রত করে মানুষদের।পুকুর পাড়ের কাছেই বাসা মুক্তিযোদ্ধা ও বরিশাল নাগরিক পরিষদের সম্পাদক এনায়েত হোসেন চৌধুরী’র।তিনি বলেন, বিসিসি এ এলাকায় ওয়াই-ফাই জোনের ব্যবস্থা করায় তরুণদের ভিড় হয় এখানে বেশি।তিনি আরোও বলেন, একসময় এ পুকুরের সঙ্গে কীর্তনখোলা নদীর যোগাযোগ থাকায় নিয়মিত জোয়ার-ভাটায় এর পানিও ভালো থাকত।এ ব্যবস্থাটি আবারও চালু করা উচিত বলে তিনি মনে করেন বরিশালবাসী।

Post a Comment

Previous Post Next Post