সংবাদ শিরোনাম

নানা সমস্যায় জর্জড়িত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়!

 নিজস্ব প্রতিবেদক ::: 


যাত্রা শুরুর এক যুগ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনও সংকট পিছু ছাড়ছে না দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বিদ্যাপীঠ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৫টি বিভাগের মধ্যে বেশিরভাগ বিভাগেই তৈরি হয়েছে ভয়াবহ সেশনজট। মাস্টার্স তো দূরের কথা, অনেক বিভাগের অনার্সও শেষ হচ্ছে না ৬-৭ বছরেও। অন্যদিকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পাঠাতে না পারায় গত চার বছর ধরে থমকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এখন পর্যন্ত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো সমাবর্তন।


বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীই এই সংকটের জন্য দায়ী করছেন উপাচার্য ড. মো. ছাদেকুল আরেফিনকে। তারা বলছেন, ভিসির সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এত সংকট। তার দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতিবাদ করায় কোণঠাসা করে রাখা হযেছে অনেক শিক্ষককে। তার বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে একাধিক অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি)। কিন্তু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে অজ্ঞাত কারণে নীরব রয়েছে ইউজিসি। এরই মধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদে বহাল থাকার জন্য জোর তদবির শুরু করেছেন উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিন।


তবে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেছেন, ‘এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হাতে আসেনি। এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিন আলোচনায় উঠে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি), গোপালগঞ্জের উপাচার্য এ কিউ এম মাহবুবের সঙ্গে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে পরস্পরের কন্যাকে একে অপরের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়ে। অথচ ওই সব পদে বুয়েট, কুয়েট, রুয়েটসহ দেশের প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক যোগ্য প্রার্থী ছিল। গোপন এই সমঝোতার ভিত্তিতে উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে নাটোরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নকারী অহনা আরেফিনকে বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জের পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে গত মার্চে বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য এ কিউ এম মাহবুবের কন্যা ফারজানা মাহবুবকে নিয়োগ দেওয়া হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে। প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ দুটির নিয়োগ বোর্ডের প্রধান ছিলেন এ দুই উপাচার্য। এ নিয়ে গত ১২ মে একটি জাতীয় প্রত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।


অভিযোগ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালকের পদটি ইউজিসির অনুমোদন পাওয়ার আগেই সেখানে উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবীরকে নিয়োগ দেন উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিন। হুমায়ুন কবীরের ছেলে জুলকার নাঈন ২০২১ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করলেও তাকে পোষ্য কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে ভর্তি করা হয়।


জ্যেষ্ঠ অনেক শিক্ষক বাদ দিয়ে অনুগত কনিষ্ঠ শিক্ষকদের বড় বড় পদে পদায়নের অভিযোগ রয়েছে এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে। পিএইচডি ডিগ্রি এমনকি উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা না থাকার পরও সম্প্রতি বাংলা বিভাগের শিক্ষক সঞ্জয় কুমার সরকারকে জীবনানন্দ দাশ রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক করা হয়েছে। একাধিক কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর পদোন্নতির ক্ষেত্রে তিনি এমন করেছেন। কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নীতিমালা থেকে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির রেয়াত সুবিধা বাদ দিয়েছেন, যা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।


অভিযোগ, অনুষদে ডিনের দায়িত্বে থাকার পরও কোনো কোনো শিক্ষককে অ্যাকাডেমিক এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। কারণ উপাচার্যের সঙ্গে তাদের মতানৈক্য রয়েছে। অনেক ডিনকে বসার রুমও দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি ডিনরা তাদের সম্মান এবং অধিকার নিশ্চিত করতে উপাচার্য বরাবর একটি লিখিত আবেদনও করেছেন। ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্যদের আপত্তি থাকলেও এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনসম্মত না হলেও ডিনদের মধ্যে সবার কনিষ্ঠ শিক্ষক সুপ্রভাত হালদারকে তিনি ‘ডিন ক্যাটাগরিতে’ সিন্ডিকেট সদস্য বানিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।


চার বছরেও জমা পড়েনি ডিপিপি


শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববদ্যিালয়টির অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আগের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমামুল হকের সময়েই মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার জন্য ৫০ কোটি টাকার ডিপিপি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু বর্তমান উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিন এসে সেই ডিপিপি জমা দেননি। ৫০ কোটির অধিক টাকার প্রকল্প আনতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিবিলিটি স্টাডি করে প্রস্তাব পাঠাতে হয়। সেটিও বর্তমান উপাচার্য পাঠাতে পারেননি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। যা আগামী ১০ বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।


পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, নেই শিক্ষককক্ষ


বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানান, অবকাঠামোগত উন্নয়ন না ঘটায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষককক্ষ সংকট চরমে উঠেছে। ফলে এক ব্যাচের পরীক্ষা শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় অন্য ব্যাচের ক্লাস। আবার কোনো কোনো বিভাগের ৬-৭টি ব্যাচের জন্য রয়েছে মাত্র একটি ক্লাসরুম। ফাঁকা ক্লাসরুম খুঁজতে ছাত্র-শিক্ষকদের ক্লাসের সময় শেষ হয়ে যায়। শিক্ষকদের বসার জায়গা নেই; এক কক্ষে গাদাগাদি করে বসেন ৪-৫ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন ডিনের মধ্যে নিজস্ব কক্ষ রয়েছে মাত্র দুজনের।


অবকাঠামোগত তীব্র সংকট থাকার পরও চলতি বছর উপাচার্য ‘সমাজকর্ম’ নামে নতুন একটি বিভাগ চালু করেছেন। পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে তিনি এই বিভাগ খুলেছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, এই বিভাগেরও কোনো নির্দিষ্ট ক্লাসরুম নেই।


এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটও রয়েছে। সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের জন্য মানসম্মত পৃথক অডিটোরিয়াম নেই, নেই পর্যাপ্ত গবেষণাগারও। লাইব্রেরিতে নেই প্রয়োজনীয় বই। পরিবহন সুবিধা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি।


সেশন জট চরমে, ৬-৭ বছরেও শেষ হয়নি অনার্স


শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অভিযোগ, উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের অদক্ষতা এবং অব্যবস্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫টি বিভাগের মধ্যে বেশিরভাগেই ভয়াবহ সেশনজট তৈরি হয়েছে। ৬-৭ বছরে মাস্টার্স তো দূরের কথা, অনেক বিভাগে অনার্সও শেষ হচ্ছে না।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কম্পিউটার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, কোস্টাল অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, অর্থনীতি বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগ, গণিত বিভাগ, লোকপ্রশাসন বিভাগ ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে সেশনজট চরমে উঠেছে। ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, কম্পিউটার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কোস্টাল অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজেমেন্ট, অর্থনীতি বিভাগ ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে সাত বছরও লেগে যাচ্ছে।


এক যুগেও হয়নি কোনো সমাবর্তন


২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি চারটি অনুষদের ছয়টি বিভাগের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। দীর্ঘ এক যুগে ৬টি ব্যাচে স্নাতক শেষে করেছেন অন্তত পাঁচ সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। স্নাতকোত্তর শেষ করেছে ছয়টি ব্যাচ। অথচ এখনও হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো সমাবর্তন। সাবেক শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বার বার সমাবর্তনের আবেদন জানানো হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো এক অজানা কারণে সাড়া দিচ্ছে না।


বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে আমার স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল পাই ২০২২ সালে। সেশন জট না থাকলে আমার মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালে। সমাবর্তন শিক্ষার্থীদের কাছে যেমন আনন্দের, তেমনি গৌরবেরও। একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের পূর্ণতা পায় সমাবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন হয়নি। যেটা দুঃখজনক।


সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন


নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, ‘সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারকি প্রতিষ্ঠান তথা অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের অপকর্মের বিষয়ে অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও ইউজিসি অজ্ঞাত কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে, যা কাম্য নয়। উপাচার্যের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সংকট ও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। যার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’


বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মো. আব্দুল কাইউম বলেন, ‘গত চার বছরে উপাচার্য সাদেকুল আরেফিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য কোনো উদ্যোগই নেননি। তার অনিয়ম, অদক্ষতা ও স্বৈরশাসনের কারণে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ধ্বংসের পথে। ভালো নেতৃত্ব না এলে প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানো কঠিন।’


সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. মোহাম্মদ আবদুল বাতেন চৌধুরী বলেন, ‘উপাচার্য স্যারের অযোগ্যতার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রত্যাশা একটি ভালো নেতৃত্ব এসে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বাঁচাবে এবং বিশ্বমানের করে তুলবে।’


এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ড. মো. ছাদেকুল আরেফিনকে বার বার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস ও হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।


বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া এ সব সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে অবকাঠামোগত উন্নয়ন একেবারেই হয়নি। এজন্য আরও বেশি উদ্যোগ এবং জোরালো নেতৃত্ব এখন সময়ের দাবি।’ সেশনজট নিরসনে সুপরিকল্পনা এবং সমন্বয় প্রয়োজন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে উপাচার্যের অনিয়মের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।’

সূত্র- বরিশাল বাণী

Post a Comment

Previous Post Next Post