প্রশাসনে উপসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব পদের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁরা মূলত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২২ ও ২৯তম ব্যাচের কর্মকর্তা। একই সঙ্গে অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত ১৩তম ব্যাচের দ্বিতীয় ভাগে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের সচিব পদে পদোন্নতি দিতে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এই ব্যাচের একটি অংশ আগেই পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছিল।গত শনিবার ছুটির দিন এবং গত রবিবার অফিস ছুটির পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত বৈঠক করেছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। এই পদোন্নতি ঘিরে পছন্দের কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য মন্ত্রী-এমপিসহ রাজনৈতিক নেতারা মৌখিকভাবে তদবির করছেন। অনেকে আধাসরকারি পত্রও (ডিও লেটার) দিচ্ছেন।আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আগে পদোন্নতির জন্য এসব ব্যাচের কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করছেন।এ অবস্থায় ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব আছেন তাঁরাও পদোন্নতির চেষ্টা করছেন। আগামী বছরের এপ্রিলে তাঁরা পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য হবেন। আর ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য হবেন আগামী সেপ্টেম্বর মাসে। এই দুটি ব্যাচ ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছিল
আর ২২ ও ২৯তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পান ২০০৩ ও ২০১১ সালে।এর আগে প্রশাসনে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে শূন্য পদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এখন আবার পদোন্নতি দেওয়া হলে যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে অতিরিক্ত কর্মকর্তা আরো বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়ছে সরকারের ব্যয়।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, যুগ্ম সচিবের ক্ষেত্রে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২২তম এবং উপসচিবের ক্ষেত্রে ২৯তম ব্যাচকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।২২তম ব্যাচের ২৪৫ জন ছাড়াও ইকোনমিক ক্যাডার থেকে একীভূত হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে আসা ৩৯ জন কর্মকর্তাও এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত আছেন। আছেন বিভিন্ন সময় পদোন্নতিবঞ্চিত একাধিক ব্যাচের শতাধিক কর্মকর্তাও।উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির জন্য ২৯তম ব্যাচের ১৮৯ জন, বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডার এবং আগের বঞ্চিত ৫৫ জনসহ প্রায় আড়াই শ কর্মকর্তা থেকে পদোন্নতি দেওয়া হবে। তবে যেহেতু খালি পদ নেই তাই কতজন পদোন্নতি পাবেন তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যাও নেই। এসএসবি যতজনকে সুপারিশ করবে ততজন পদোন্নতির জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উপসচিব ও যুগ্ম সচিব মিলে প্রায় আট শ কর্মকর্তার কর্মজীবনের নথিপত্র পর্যালোচনা করছে এসএসবি। পর্যালোচনা শেষে পদোন্নতির সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
ছুটির দিন পদোন্নতির বৈঠক
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অতীতে আন্তর্জাতিক সমস্যা, জাতীয় দুর্যোগ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে মাঝে-মধ্যে ছুটির দিন অফিস খোলা রাখা হয়েছে। পদোন্নতিসংক্রান্ত বৈঠকের কারণে ছুটির দিন অফিস খোলা রাখার তথ্য কারো কাছে নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসএসবি বোর্ডের এক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পদোন্নতির জন্য তদবির অনেকে বেড়েছে। অফিস চলাকালীন সময় ঠিকমতো বৈঠকও করা যায় না। বৈঠক থেকে বের হলেই নানাভাবে তদবির আসে। গণদৃশ্য থেকে দূরে থাকতে ছুটির দিন ও অফিস সময়ের পরে পদোন্নতিসংক্রান্ত বৈঠক করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘ। তাই ছুটির দিন ও অফিস সময়ের পরে পদোন্নতিসংক্রান্ত কমিটির বৈঠক করা হয়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, জনস্বার্থে বা কাজের স্বার্থে ছুটির দিন পদোন্নতিসংক্রান্ত বৈঠক করলে সমস্যা নেই। কিন্তু স্বজনপ্রীতি হলে সমস্যা। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় ছুটির দিন পদোন্নতিসংক্রান্ত বৈঠক হয়েছে কি না মনে পড়ছে না। তবে জরুরি প্রয়োজনে দুই-এক দিন হতেও পারে।’
পদের অতিরিক্ত পদোন্নতির বিষয়ে মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ডিউটি পদে এবং জুনিয়র কর্মকর্তাদের সুপারনিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত) পদে পদায়ন করা উচিত। এতে প্রশাসনে ভারসাম্য থাকবে।
পদায়ন নিয়ে হবে জটিলতা
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গতকাল মঙ্গলবারের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে যুগ্ম সচিবের নিয়মিত পদ ৩৩২টি। কর্মরত আছেন ৭২৫ জন কর্মকর্তা। এটা পদসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি। এখন এই পদে আরো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। উপসচিবের অনুমোদিত পদ এক হাজার ৪২৮টি। কর্মরত আছেন এক হাজার ৬৯৮ জন। অতিরিক্ত কর্মকর্তারা সুপারনিউমারারি হিসেবে কাজ করছেন। শূন্য পদ না থাকায় পদোন্নতিপ্রাপ্ত বেশির ভাগ কর্মকর্তাকেই যথারীতি আগের পদে রাখা হবে। এ নিয়ে প্রশাসনে জটিলতা তৈরি হবে। কারণ জুনিয়র অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েই ডিউটি পদে পদায়ন করা হবে। আর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সুপারনিউমারারি হিসেবে থেকে যাবেন। এতে ক্ষোভ বাড়বে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে।
২০ ও ২১ ব্যাচসহ অন্যান্য ব্যাচের যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। কিন্তু সরকারের নির্দেশনা আছে ডিউটি পদে থাকবেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এবং সুপারনিউমারারি পদে কাজ করবেন কনিষ্ঠ কর্মকর্তারা।
ভাঙতে পারে ২২তম ব্যাচ
বিসিএস ২০তম ব্যাচে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা ছিলেন প্রায় ৩০০ জন। কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই ব্যাচকে দুইভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তা কম থাকায় তাদের একসঙ্গে পদোন্নতি হয়েছিল। এবার ২২তম ব্যাচেও পদোন্নতিযোগ্য প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা আছেন। এ ছাড়া পদের চেয়ে দুই গুণ কর্মকর্তা থাকায় এই ব্যাচকেও দুইভাবে পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে।
পদোন্নতির জন্য মন্ত্রীদের তদবির
সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২-এ বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সচিব কিংবা সচিব পদে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পুরো চাকরিকালে পালনকৃত দায়িত্বের গুরুত্ব ও প্রকৃতি এবং তাঁর ব্যক্তিগত সুনামসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করা হবে। পদোন্নতি প্রদানের ভিত্তি হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত ১০০ নম্বরও রয়েছে। এসএসবি এসব মানদণ্ড বিবেচনা করে পদোন্নতির সুপারিশ করবে।
কিন্তু জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একটি প্রকল্পের পরিচালক (উপসচিব) মো. নুরুল আমিনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিতে ডিও লেটার দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক (উপসচিব) আব্দুল আখেরের জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল ইসলামের জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মোমিনুর রশীদের জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। বাংলাদেশ হাই টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ রেজাউল করিমকে গ্রেড-১-এ পদোন্নতি দিতে ডিও লেটার দিয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রঞ্জিত কুমার দাসকে গ্রেড-১-এ পদোন্নতি দিতে ডিও লেটার দিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী ডিও লেটার নেওয়া নিষিদ্ধ। এটা জেনেও অনেকে তদবির করেন। কারণ অনেকের আত্মীয়স্বজন থাকেন, সে জন্য হয়তো না করতে পারেন না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পদের জন্য উপযুক্ত না হলে কারো অনুরোধে কাজ হয় না।
Post a Comment